
প্রাপ্তবয়ষ্ক তিলা মুনিয়া।
২০০৯-এর সেপ্টেম্বর। গাজীপুরের ব্র্যাক সেন্টারে একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করছিলাম। চা বিরতির ফাঁকে ক্যামেরা হাতে আশপাশটা দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি কাশফুল উড়ে যেতে দেখলাম। তাজ্জব ব্যাপার, কাশফুলও কি উড়তে পারে! পিছু নিলাম। কিন্তু মূহুর্তেই এটি একটি থুজা গাছের ঝোঁপে হারিয়ে গেল। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। খুব সাবধানে থুজা গাছটি পরীক্ষা করলাম। গাছের ঠিক মাঝ বরাবর ছোট্ট একটি পাখিকে কাশফুল দিয়ে বাসা বানাতে দেখলাম। তাহলে কিছুক্ষণ আগে সে-ই ঠোঁটে করে কাশফুলটি নিয়ে উড়ে আসছিল।
এতক্ষণ যার কথা বললাম সে আমাদের অতি পরিচিত গায়ক পাখি তিলা মুনিয়া (Scally-breasted Munia)। বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura punctulata. এদেশের শহর-বন্দর-গ্রামে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। লম্বায় ১১.৫ সেমি। মাথা থেকে লেজের ডগা জলপাই-বাদামি। গলাও তাই। চিবুক গাঢ় রঙের। বুকের উপরটা খয়েরি। পেট কালচে-বাদামি। তাতে সাদা ফোঁটা থাকে। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। বাচ্চাগুলোর দেহের উপরটা বাদামি ও নিচটা লালচে-হলুদ। বুকে কোন ফোঁটা নেই।
মুনিয়া বেশ চঞ্চল। এ ডাল থেকে ও ডাল করে বেড়ায়। ফসলের ক্ষেত, মাঠ, নল-খাগড়ার বন, বাগান প্রভৃতি স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ে বেড়ায়। ২৫শে সেপ্টেম্বর বশেমুরকৃবিতে একটি ঝাঁকে ৭০টি তিলা মুনিয়া দেখেছি। এদের ঠোঁট খাটো ও বেশ শক্ত। ধান বা অন্যান্য শস্যদানা মুখে রেখেই তা থেকে শক্ত খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারে। ঘাসবীচি ও কীটপতঙ্গও খায়। এমনিতে নিরীহ হলেও ঝাঁক বেঁধে ফসলের ক্ষতিও করতে পারে।

তিলা মুনিয়ার বাচ্চা।
মে-সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। খেজুর গাছের মথির ঘন পাতার আড়ালে, লতা-ঝোঁপে, বাবলা, ঝাউ, কেয়া, কান্তা, দেবদারু প্রভৃতি গাছে গোলাকৃতির বাসা বোনে। ঘাস-লতা-ধান পাতা দিয়ে সুন্দর, নরম ও তুলট বাসাটির ভিত্তি রচনা করে। কাশফুল দিয়ে চারপাশটা মুড়ে নেয়। বাসার ভিতরে থাকে কাশফুলের গদি। বাসায় ঢোকার জন্য গোপন সরু পথ বানায় যেন শত্রুরা না দেখে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাসা বানায়। বশেমুরকৃবিতে বিল্ডিংয়ের কার্নিশের নিচে ও টোনারের খালি কার্টুনে বাসা বানাতে দেখেছি। একমাত্র গ্র্যাজুয়েট ফ্যাকাল্টি ও আশেপাশে গত বছর ২৭টি ও এবছর ২৩টি বাসা দেখেছি। ডেপুটি রেজিস্ট্রার জহুরুল আমিন তার রুমের জানালায় গত বছর তিনটি খালি কার্টুন রেখেছিলেন। মুনিয়া সেখানে বাসা বানিয়ে ডিম-বাচ্চা তুলেছিল। তবে একটি বাসা থেকে সম্ভবত পোষার জন্য কেউ বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায়। এবছর মাত্র একটি বাসা টিকে আছে। স্ত্রী মুনিয়া ৪-৮টি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৩-১৫ দিনে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।

প্রাপ্তবয়ষ্ক তিলা মুনিয়া।
শহুরে মানুষের কাছে পোষা পাখি হিসেবে মুনিয়া বেশ জনপ্রিয়। খাঁচাবন্দি মুনিয়া রাস্তা-ঘাট ও পেটশপে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিক্রেতারা এদের গায়ে নীল, হলুদ, সবুজ বা উজ্জ্বল রঙ লাগিয়ে দেয় যা গোসল করালেই উঠে যায়। পাখি পোষা মানুষের পুরনো সখ। আর এ সখের জন্য বলি হয় লাখো প্রকৃতিক পাখি। মুনিয়াদের আবদ্ধাবস্থায় পালন ও বংশবৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু প্রকৃতিতেই যে পাখি সহজলভ্য, কষ্ট করে ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে তাদের বংশবৃদ্ধি করে বিক্রি করবে তা-কি বিশ্বাসযোগ্য? গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এদেরকে জাল দিয়ে ধরে টঙ্গি, ঢাকার কাঁটাবন ও অন্যান্য স্থানে বিক্রি করা হয় বলে জেনেছি। কাজেই যারা পাখি পোষেন তাদের কাছে অনুরোধ আবদ্ধাবস্থায় ব্রিডিং করা বিদেশি পাখি পুষুন। দয়া করে কেউ প্রকৃতির পাখিদের খাঁচাবন্দি করবেন না। তাহলে হয়তো একদিন সহজলভ্য তিলা মুনিয়াগুলোও প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে।
প্রবন্ধটির লেখক ও আলোকচিত্রী ড. আ ন ম আমিনুর রহমান একজন বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী, প্রাণীচিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
The post আমাদের তিলা মুনিয়া appeared first on NSSB.